বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২৩ তথ্যচিত্র

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০২৩ তথ্যচিত্র

Generic placeholder image
  Ashfak

তামাক চাষ কৃষকের স্বাস্থ্য, মাটির স্বাস্থ্য এবং সার্বিকভাবে গোটা জনস্বাস্থ্য ও পৃথিবীরস্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন করে।দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক প্রতিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্য সংকট সৃষ্টিতেও ভুমিকা রাখে তামাক। ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। বিকল্প খাদ্য ফসল উৎপাদন ও বিপণনের সুযোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই ও পুষ্টিকর ফসল চাষে তামাক চাষিদের উৎসাহিত করতে এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘গ্রো ফুড, নট টোব্যাকো’। 1 তামাক উৎপাদনে কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচনও এবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপিত হতে যাচ্ছে ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে।

তামাক নয়, খাদ্যশস্য
বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান খাদ্য সংকটের পিছনে সংঘাত-যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ মহামারির অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের পাশাপাশি তামাক চাষের একটি প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে, পৃথিবীর ১২৫টিরও বেশি দেশের প্রায় ৪ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয় এবং শীর্ষ তামাক উৎপাদনকারী দেশগুলোর অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ভুক্ত দেশ। 2 পৃথিবীব্যাপী উৎকৃষ্ট মানের জমি ক্রমবর্ধমানহারে তামাকচাষে ব্যবহৃত হওয়ায় খাদ্য ফসলের জমি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এসব জমি খাদ্যফসল ফলানোর কাজে ব্যবহার করা গেলে লক্ষ লক্ষ মানুষের খাদ্য চাহিদা পুরণের পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তার সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। তামাক শ্রম-নির্ভর ফসল। তামাক চাষের শুরু থেকে বিক্রয় পর্যন্ত প্রায় ৯ মাস সময় লাগে ফলে এই জমিতে অন্য খাদ্য শস্য চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তামাকচাষ যেহেতু মাটির উর্বরতা হ্রাস করে তাই এই জমিতে অন্যান্য ফসল উৎপাদনের ক্ষমতাও কমতে থাকে এবং একই জমিতে পরপর দুই বা ততোধিক ফসল
উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। 

তামাক চাষ টেকসই খাদ্য নিরপত্তার জন্য হুমকি: বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ খুবই কম, মাত্র ৩ কোটি ৭৬ লক্ষ ৭ হাজার একর। অথচ তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। 4 বিশ্বের মোট তামাকের ১.৩ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। 5 তামাকচাষের কারণে খাদ্য ফসলের জমি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে রবি মৌসুমের প্রধান খাদ্য ফসলগুলোর মধ্যে বোরো, গম এবং আলু অন্যতম এবং এ মৌসুমেই তামাক চাষ হয়ে থাকে। এক একর জমিতে তামাক চাষ মানেই সেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদিত না হওয়া। সর্বশেষ কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ- ২০২১ অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাক চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণ ৯৯,৬০০.২৪ একর। 6 ২০২১ মৌসুমে বোরো, গম এবং আলুর একরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১,৬৮১ কেজি, ১,৩৩৫ কেজি এবং ৮,৫৩৮ কেজি। তামাকের পরিবর্তে এই জমিতে বোরো চাষ করা হলে ১,৬৭,৪২৮ মেট্রিক টন বোরো, গম এবং আলু চাষ করা হলে যথাক্রমে ১,৩২,৯৬৬ মেট্রিক টন গম এবং ৮,৫০,৩৮৭ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন করা সম্ভব হতো। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ এবং নানাবিধ বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে বাংলাদেশের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি ক্রমশ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এমতাবস্থায় তামাকের মত একটি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিধ্বংসী ফসল উৎপাদনের বিপরীতে এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য হারানোর ক্ষতি কোনোভাবেই জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

তামাক চাষ কৃষকের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি: তামাক চাষিদের মধ্যে ৪ জনে ১ জন গ্রিন টোব্যাকো সিকনেস নামে নিকোটিন বিষক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত। 7 তামাক পাতা নাড়াচাড়ার সময় ত্বকের মাধ্যমে নিকোটিন শোষিত হওয়ার কারণে এই রোগ হয়। রোগের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে বমি বমি ভাব, বমি, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। 8 ক্ষেতে কাজ করার সময় অজ্ঞাতসারেই একজন তামাক চাষি দিনে প্রায় ৫০টি সিগারেটের সমপরিমাণ নিকোটিন শোষণ করে থাকে। 9 এমনকি তামাক চাষিদের শরীর, ব্যবহৃত জামা ও জুতার সাথে বিষাক্ত উপাদান বাড়িতে চলে আসায় পরিবারের অন্যান্য সদস্য বিশেষ করে শিশুরা পরোক্ষ স্বাস্থ্যক্ষতির শিকার হয়। তামাক চাষের মৌসুমে নারী এবং শিশুদের বাধ্যতামূলকভাবে শ্রম দিতে হয় বিধায় তারা মারাত্মক ভাবে তামাকের স্বাস্থ্যক্ষতির শিকার হয়। শিশুদের দৈহিক ওজন কম থাকায় ত্বকের মাধ্যমে নিকোটিন শোষিত হওয়ায় তারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে থাকে। তামাক চাষ মাটির স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি: তামাক অন্যান্য শস্যের তুলনায় দ্রুত মাটির পুষ্টি নিঃশেষ করে মাটিকে অনুর্বর করে ফেলে। যেমন, ভুট্টার তুলনায় তামাক মাটি থেকে প্রায় আড়াই গুণ বেশি নাইট্রোজেন, সাত গুণ বেশি ফসফরাস, এবং আট গুণ বেশি পটাসিয়াম শোষণ করে থাকে। একক জাতীয় ফসল (মনোক্রপ) হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের কিটপতঙ্গ ও রোগের আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য তামাক চাষে অন্যান্য ফসলের তুলনায় রাসায়নিক সার ও কিটনাশকও বেশি ব্যবহার করতে হয়। 10 এসব রাসায়নিক উপাদান পরবর্তীতে পানির সাথে ধুয়ে আশেপাশের নদী, খাল, জলাশয় ও খাবার পানির উৎসগুলোকে দূষিত করে।

তামাক চাষ পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রের জন্য হুমকি: 
টোব্যাকো অ্যাটলাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩১ শতাংশ বননিধনের পেছনে তামাক চাষ দায়ী। 11 গবেষণায় দেখা গেছে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার তিনটি উপজেলায় তামাকপাতা শুকানোর (কিউরিং) কাজে এক বছরেই প্রায় ৮৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে। 12 স্থানীয় বন থেকে এইসব কাঠ সংগ্রহ করায় পাহাড়গুলো বৃক্ষহীন হয়ে পড়ছে এবং সেখানকার অধিবাসীরা আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধ্বসের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া তামাক চাষে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নিকটস্থ জলাশয়ে মিশে মৎস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তামাক চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক হালদা নদীর পানিতে মিশে যাওয়ায় কারণে বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রটি হুমকির মুখে পড়েছে। 13 তামাক চাষ মিথ্যা মুনাফার ফাঁদ: বাংলাদেশে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় 14 দেখা গেছে, তামাক চাষে অতিরিক্ত যে লাভের কথা প্রচার করা হয়, তার প্রায় সবটাই বানোয়াট। আপাতদৃষ্টিতে তামাক চাষে বেশি আয় উপার্জন হলেও এই আয় থেকে পারিবারিক শ্রমের পারিতোষিক, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত নিজস্ব গাছের/কাঠের দাম, পরিবেশের ক্ষতি, স্বাস্থ্য ব্যয় ইত্যাদি বাদ দিলে তামাক চাষে লাভের বদলে ক্ষতি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক চাষে নেট সোশ্যাল রিটার্ন ঋণাত্মক, প্রতি একরে ক্ষতি ৯১৬.১১ ডলার। কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ একজন তামাকচাষি বছরে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে গড়ে ২০৪৬ শ্রম ঘণ্টা পরিমাণ শ্রম কোন প্রকার মজুরি ছাড়াই নিয়ে থাকে। কখনোই তামাক চাষ করেনি, এমন কৃষকের ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে নেয়া শ্রম ঘন্টার পরিমাণ প্রায় অর্ধেকেরও কম, মাত্র ৯৫২ ঘণ্টা। অর্থাৎ তামাক চাষিদের ক্ষেত্রে পরিবারের নারী ও শিশুদের মাঠে অনেক বেশি পরিমাণ সময় ব্যয় করতে হয়, যার ফলে তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা, বিনোদন ও বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। তামাক চাষে একর প্রতি বিনিয়োগের রিটার্ন (আরওআই) ২২ শতাংশ, অথচ অন্যান্য শস্যের ক্ষেত্রে এই হার ১১৭ থেকে ১৫২ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। গবেষণাটিতে দেখা গেছে, অতিরিক্ত মুনাফা নয়, বরং কোম্পানির পক্ষ থেকে তামাকপাতা ক্রয়ের আগাম নিশ্চয়তা এবং সহজে বাজারে অভিগম্যতার সুযোগ থাকার কারণেই তামাক চাষে ঝুঁকছে কৃষকেরা।
তামাক চাষের ক্ষতি ঢাকতে কোম্পানির কূটকৌশল: তামাক চাষের ক্ষতি থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্য তামাক কোম্পানিগুলো প্রায়শই নিজেদের অত্যন্ত পরিবেশ বান্ধব হিসেবে উপস্থাপন করে। তথাকথিত সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচির (সিএসআর) মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ঘটানো ক্ষতি আড়াল করে এবং দায় এড়ানোর চেষ্টা করে। উদাহরণ হিসেবে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)-এর বলা যেতে পারে। কোম্পানিটি প্রায়শই বেশ গর্ব করে নিজেদের সিএসআর কর্মসূচি ‘বনায়ন’ এর প্রচার করে থাকে। কোম্পানিটির দাবি, গত চার দশকে তারা লক্ষ লক্ষ গাছের চারা বিতরণ করেছে। 15 আপাতদৃষ্টিতে বেশ মহতী উদ্যোগ প্রতীয়মান হলেও আসল সত্য হচ্ছে তামাকপাতা শুকাতে জ্বালানির জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশে অন্তত ২৯ লাখ পুর্ণ বয়স্ক গাছ কাটা হয়। এধরনের সিএসআর কার্যক্রমের আড়ালে কোম্পানিটি মূলত স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সঙ্গে সর্ম্পক স্থাপন করে, যা পরবর্তীতে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়নে হস্তক্ষেপ করতে এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ উদ্ধারে কাজে লাগায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যেসব এলাকায় চাষিরা বিএটিবি’র জন্য তামাক চাষ করে, মূলত: সেসব এলাকাতেই কোম্পানিটি সিএসআর কার্যক্রম করে থাকে। যার মূল উদ্দেশ্য, তামাক চাষের কারণে অত্র এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও ইকোসিস্টেম এর ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ে, তা আড়াল করা।

করণীয়
বাংলাদেশে তামাকজনিত অসুস্থতায় প্রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। 16 দেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। 17 তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ব্যয় ও কর্মক্ষমতা হ্রাসের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। 18 তামাকের এসব ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করেই তামাক নিয়ন্ত্রণকে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অন্তর্ভুক্ত (টার্গেট ৩এ) করা হয়েছে। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তামাকের সরবরাহ এবং চাহিদা কমিয়ে আনাই হতে পারে তামাকের নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার সঠিক উপায়। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলি নেয়া যেতে পারে:
১। ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধনী
অবিলম্বে চূড়ান্ত করা;
২। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)-এর
আর্টিকেল ১৭ এবং ১৮ অনুসারে তামাক চাষ নিরুৎসাহিতকরণে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা;
৩। তামাক কোম্পানির কূটকৌশল ও হস্তক্ষেপ মোকাবেলায় এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ অনুসারে
নীতিমালা প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করা; এবং
৪। তামাকের ওপর ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক পুনর্বহাল করা।
 

মন্তব্য করুন হিসাবে:

মন্তব্য করুন (0)