বাসে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য থামছেই না

Generic placeholder image
  

করোনার ধাক্কা মানুষ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে
মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের চরম
এক দুঃসময়ে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি বাড়ানো
হলো। ফলে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। পরিবহন ব্যয় দ্বিগুণ হওয়ার
পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে।

আমাদের দেশে সাধারণত তেলের দাম যে পরিমাণ বাড়ে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি বাড়ে
বাস ও অন্যান্য গণপরিবহন ভাড়া। পণ্য পরিবহন ভাড়াও ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দেয় ট্রাক-
কাভার্ডভ্যান মালিকরা। বাসের ক্ষেত্রে সরকার ও বাসের মালিক-শ্রমিক নেতারা
মিলেমিশে একচেটিয়াভাবে ভাড়া নির্ধারণ করে। নির্ধারিত ভাড়ারও কয়েকগুণ বাড়তি
ভাড়া আদায় করে বাসের শ্রমিকরা। সরকার বর্ধিত ভাড়া আদায় বন্ধে তেমন কোনো
কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ হচ্ছে দেশের ৯০ ভাগ বাসের মালিক হচ্ছে
রাজনৈতিক নেতারা। বাসের মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেটের কাছে আজ সাধারণ মানুষ
জিম্মি হয়ে পড়েছে।

সরকার ২০২১ সালের নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে এক লাফে
১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করেছিল। তখন বাস ভাড়া প্রায় ২৭ শতাংশ ও লঞ্চ
ভাড়া ৩৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই সময়ে তেলের দামের চেয়ে বেশি হারে বাস ও লঞ্চের
ভাড়া বেড়েছিল। বিআরটিএ থেকে সর্বনিমন্ন বাস ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১০ টাকা
এবং কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ছিল ২ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু বাসের সুপারভাইজাররা
যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করত কিলোমিটার প্রতি ৮ টাকা থেকে ১০ টাকা। এতে
বাসের মালিক এবং শ্রমিক সিন্ডিকেট গত কয়েক মাসে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে
হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এক বছর না হতেই সরকার আবার জ্বালানি
তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। তেলের দাম বাড়াতে
লাভোবান হচ্ছে একশ্রেণির অসাধু বাস মালিক এবং শ্রমিক সিন্ডিকেট। এবারও একই

ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের
ওপর। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি হয়নি। সবকিছু
মিলে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় কতদিন টিকে থাকা যাবে তা
বলা অনিশ্চিত।


বিশেষ করে বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম কমছে, তখন দেশে ৫০ শতাংশ জ্বালানি
তেলের দাম বাড়ানো হলো। এটি অন্যায় এবং অযৌক্তিক। বাংলাদেশে ৯৭ শতাংশ
চাষাবাদ মেশিন দিয়ে চাষ করা হয়। কিন্তু নতুন সিদ্ধান্তের ফলে কৃষকের সেচে খরচ
বাড়বে কয়েকগুণ। কৃষক সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেকেই চাষাবাদ বন্ধ করে দেবে।
ফসল উৎপাদনের পর অনেকেই ন্যায্যমূল্য পাবে না। যার ফলে দেশে খাদ্য সংকটে
ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ।

ভোক্তাপর্যায়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ১১৪ টাকা, কেরোসিন ১১৪ টাকা, অকটেন ১৩৫
টাকা এবং পেট্রলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
নতুন এই মূল্য সম্প্রতি এক শুক্রবার রাত ১২টা থেকেই কার্যকর হয়েছে। ৮ মাসের
ব্যবধানে আবার বাড়ানো হলো তেলের দাম। তবে ওই সময় পেট্রল আর অকটেনের দাম
অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। এবার সব ধরনের জ্বালানি তেলেরই দাম বাড়ানো হলো।

দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিককে যাতায়াত ভাতা দেওয়া হয় না। তারা শুধু বেতন পায়।
বেতনের টাকা থেকেই যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু সিদ্ধান্তের ফলে ঢাকায় প্রতিজনের
যাতায়াত খরচ ৭০ থেকে ২শ টাকা পর্যন্ত বাড়বে। প্রতি মাসে বাড়বে ২ হাজার ১শ
থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া খুবই কঠিন হবে।

সম্প্রতি হঠাৎ করেই শুক্রবার রাত ১২টার পর নতুন দাম কার্যকর হবে বলে ঘোষণা
দেওয়া হয়। এই খবরে অর্থ সাশ্রয়ের আশায় অনেক মানুষ ছুটতে থাকেন তেলের
পাম্পগুলোর দিকে। উদ্দেশ্য ১২টার আগেই পুরোনো দামে জ্বালানি তেল কেনা। তবে
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থ হয়েছেন। মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা শুনে অধিকাংশ পাম্প
মালিক জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ করে দেন। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা গ্রাহকরা বিভিন্ন
স্থানে বিক্ষোভ করেছেন। তারা অনেক রাত পর্যন্ত সড়কও অবরোধ করে রাখেন।
তবুও তেল মেলেনি। শনিবার থেকে বর্ধিত মূল্যে তেল বিক্রি শুরু হলে পরিস্থিতি ধীরে
ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। তবে গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি না করায় বাস মালিক এবং
শ্রমিকরা অনেকটা অঘোষিত ধর্মঘট পালন করে। সড়কে সামান্য কিছু পরিবহন
চলছিল। তাদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের দফায় দফায় গণ্ডগোল হতে দেখা গেছে।

এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধিতে জনমনে তীব্র ক্ষোভ, সংশয়
ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার মূল্যবৃদ্ধির রাতে তেলের জন্য পাম্পে পাম্পে
বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। এর প্রভাব দেখা যায় শনিবারও। এদিন ঢাকাসহ দেশজুড়ে
গণপরিবহন সংকট ছিল চরমে। তেলের দামের সঙ্গে ভাড়া সমন্বয়ের অভাবে
গণপরিবহনে অঘোষিত ধর্মঘট পালিত হয়েছে। সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথ ছিল প্রায়
ফাঁকা। বাসের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে বিক্ষুব্ধ মানুষ।
অনেক সময় পরপর দু-একটা বাস এলেও তাদের বেশির ভাগেই উঠতে পারেননি নারী, শিশু
ও বয়স্ক যাত্রীরা। যারা উঠেছেন, তাদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে।
বেশি ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডাও হয় অনেক স্থানে। অফিসগামী
যাত্রীদের হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। সকাল ও সন্ধ্যার দিকের যাত্রীদের সীমাহীন
দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। দেশের অনেক এলাকায় বাস রাস্তায় নামানোর জন্য পরিবহন
শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে জ্বালানি তেলে চলে না এমন
পরিবহনেও চলাচলের সুযোগ ছিল না। কারণ সংকট টের পেয়ে তারাও কয়েক গুণ ভাড়া
বাড়িয়েছে। শুধু রাজধানীর ঢাকা শহরে বাসে ১০ টাকার ভাড়া নিচ্ছে ২০ টাকা, ২৫ টাকার
ভাড়া নিচ্ছে ৩০ টাকা, ৩৫ টাকার ভাড়া নিচ্ছে ৫০ টাকা। দূরপাল্লার বাসের ভাড়াও
বাড়ানো হয়েছে। ৪৫০ টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। ঢাকা-কুমিল্লা-
লাকসাম, ঢাকা-চাঁদপুর, ঢাকা-নরসিংদী-ভৈরব, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-
বরিশাল, ঢাকা-ভাঙ্গাসহ বিভিন্ন রুটে বাস ভাড়া আগের চেয়ে ১০০ থেকে ২০০ টাকা
করে বৃদ্ধি করা হয়েছে। দূরপাল্লার রুটগুলোতে বাসভাড়া যাত্রীপ্রতি এক লাফে ২০০
টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। নতুন ভাড়া কার্যকর করায় সাধারণ যাত্রীদের মাথায় চাপল
বাড়তি খরচের বোঝা। ঢাকা থেকে খুলনার ২৭২ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে একজন
যাত্রীর ৬৯১ টাকা বাস ভাড়া লাগত। সরকারি হিসাবেই রোববার তা দাঁড়িয়েছে ৮৮৬
টাকায়। গণপরিবহনে চলছে এখন লুটপাটের মতো অবস্থা। যে যার মতো করে ভাড়া
আদায় করছে। কোনো নিয়ম-কানুনের বালাই মানছে না বাস শ্রমিকরা। বাসের নৈরাজ্য
যেন থামছেই না। কিন্তু আয় তো বাড়ছে না। আমরা বাঁচব কীভাবে? জীবন চলবে
কীভাবে? কোনো কিছুরই উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। সবমিলিয়ে এক হাঁসফাঁস অবস্থা তৈরি
হয়েছে। এর ফলে কিছু মানুষ গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হবে। সরকারিভাবে প্রতি
কিলোমিটারে ভাড়া ২.৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ভাড়ার কোনো তালিকা গণপরিবহণে
নেই। যার কারণে প্রতিনিয়ত সাধারণ যাত্রী এবং বাস সুপারভাইজারদের কথাকাটাকাটি
থেকে একপর্যায়ে হাতাহাতিতে গড়ায়। এর দায়ভার কার। কে শুনবে সাধারণ যাত্রীদের
দুর্দশার কথা। কে করবে এর সমাধান?

মন্তব্য করুন হিসাবে:

মন্তব্য করুন (0)