রাণীশংকৈলে মাল্টা চাষে আমিরুলের অভাবনীয় সাফল্য
মাল্টা সাইট্রাস ফলের মধ্যে অন্যতম ভিটামিন ‘‘সি’’সমৃদ্ধ রসালো ও জনপ্রিয় একটি ফল। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণের জন্য দারুন কার্যকরী। বিশ্বের সর্বমোট উৎপাদিত সাইট্রাস ফসলের দুই তৃতীয়াংশ হলো মাল্টা। ভিয়েতনাম, উত্তর পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ চীন মাল্টার আদি উৎপত্তি স্থল। তবে বর্তমানে এই ফলটি বিশ্বের উষ্ণ ও অব–উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় বেশী চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশে এই ফলটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং দিন দিন এর চাষ বেড়ে চলছে। কমলার তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশী হওয়ায়, পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য এলাকায় মতো একেবারে উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলায় উন্নত জাত ও আধুনিক চাসাবাদ পদ্ধতি ব্যবহার করে এর উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়ে এবং অবিশ্বাস লাভবান হয়ে অনেকের অনুপ্রেরণার পাত্র হয়েছেন কৃষক আমিরুল ইসলাম। উপজেলার ক্ষুদ্র বাঁশবাড়ি গ্রামের তফাজ্জুল হকের এর ছেলে আমিরুল ইসলাম। তিনি উপজেলার ইসলামি ফাউন্ডেশনের মডেল কেয়ারটেকার পদে চাকুরী করেন।পাশাপাশি বাড়ি পাশে এক একর জমিতে কৃষি অফিসের সার্বিক সহযোগিতায় ২৭০টি মাল্টা গাছের চারা রোপন করে একটি বাগান করেন। গত দু'বছর তেমন ফলন না হলেও এবার কৃষি অফিসের পরামর্শে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ২৭০ টি গাছে প্রায় তিনশ মনের মতো মাল্টা ধরেছে এবং এগুলোর বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক সাড়ে চার লক্ষ টাকায় বিক্রি করা যাবে। গত সোমবার ২ অক্টোবর বিকালে সরেজমিনে তার বাগানের মাল্টা তুলার সময় এমনটিই প্রতিনিধির সাক্ষাৎকারে কৃষক আমিরুল ইসলাম বলেন।
এ সময় ইউএনও শাহরিয়ার রহমান, কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সহীদুল ইসলাম,প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা স্যামুইল মার্ডি, উপ-সহকারী কৃষি অফিসার সাদেকুল ইসলাম ও আনোয়ার হোসেন,ইসলামি ফাউন্ডেশনের এফএস ফরহাদুজ্জানসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
এ ব্যপারে উপ সহকারী কৃষি অফিসার সাদেকুল ইসলাম জানান, সারাদিন রোদ পরে ও বৃষ্টির পানি জমে না এমন উচু বা মঝারি উচু জমি মাল্টা চাষের জন্য উপযোগী। আগাছা পরিস্কার ও আশেপাশে উচু গাছ থাকলে ডালা ছেঁটে দিতে হবে। সব ধরণের মাটিতে জন্মালেও সুনিষ্কাশিত,উর্বর, মধ্যম থেকে হালকা দোয়াস মাটি মাল্টা চাষের জন্য উত্তম। মধ্যম অম্ল থেকে সামান্য ক্ষারীয় মাটিতে মাল্টা জন্মে। তবে ৫.৫ থেকে ৬.৫ (ph) অম্লতায় ভালো হয়। আমরা উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর এসব জমি নির্বাচন করে চাষি ভাইদের মাল্টা বাগান করার জন্য আমরা পরামর্শ দেই। এবং কৃষি অফিস থেকে তাদের সর্বাত্মক পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছি। যেটার সুফল তিন বছর যেতে না যেতেই অনেক মাল্টা বাগান চাষি ভায়েরা পেতে শুরু করেছে।
কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শহীদুল ইসলাম বলেন, মাল্টা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারী ফল। রাণীশংকৈল উপজেলায় আমিরুল ইসলামের মতো আরো অনেকেই মাল্টা বাগান করে চরম লাভবান হয়েছেন। মাল্টা সহজেই চাষ করা যায়। এ উপজেলায় কৃষি অফিসের সার্বিক তত্বাবধানে মোট ২৮ হেক্টর জমিতে মাল্টা চাষ করা হয়েছে। উন্নত জাত ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহার করে এর উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব। দেশের কমবেশি সব অঞ্চল মাল্টা চাষের জন্য উপযোগী। গাছ প্রতি ৩০০-৪০০ টি ফল ধরে। এবং প্রতি হেক্টরে ফলন প্রায় ২০ মেট্রিক টন হয়। কম বৃষ্টিবহুল সুনির্দিষ্ট গ্রীষ্ম ও শীতকাল অর্থাৎ শুষ্ক ও উষ্ণ জলবায়ু মাল্টা চাষের জন্য সবচেয়ে বেশী উপযোগী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট “বারী মাল্টা- ১” নামে ২০০৩ সালে মাল্টার একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে, এই জাতটির পাকা ফল দেখতে সবুজ ও খেতে মিষ্টি এবং সুস্বাদু। এটি সেই জাতের মাল্টা। এটি চেনার সহজ উপায় হলো প্রতিটি ফলের নিচের দিকে পয়সা সদৃশ একটি গোলাকার দাগ স্পষ্ট বিদ্যমান থাকে। এটি নিয়মিত ফল দানকারী উচ্চ ফলনশীল জাত। গাছ খাটো, ছড়ানো ও ঝোপালো। মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য চৈত্র মাস পর্যন্ত গাছে ফুল আসে এবং কার্তিক মাসে ফল আহরনের উপযোগী হয়। ফল গোলাকার ও মাঝারি (১৫০ গ্রাম) আকৃতির। পাকা ফলের রং সবুজ। ফলের পুস্প প্রান্তে পয়সা সদৃশ সামান্য নিচু বৃত্ত বিদ্যমান। ফলের খোসা মধ্যম পুরু ও শাসের সাথে সংযুক্ত। শাস হলুদ ভাব, রসালো কিন্তু খেতে মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়। কৃষি অফিসের সহযোগিতায় এলাকার বেকার যুকদের এরকম মাল্টা বাগান করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার আহবান জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার রহমান বলেন, এ উপজেলায় ২৮ হেক্টর জমিতে মাল্টা চাষ কৃষি অফিসের একটি অভাবনীয় সাফল্য। এটি একদিকে যেমন মাল্টা চাষিদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে, অপরদিকে নিজ এলাকার চাহিদা পূরণ করে অন্য জেলাগুলোতেও রপ্তানি করে দেশে মাল্টার চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মাল্টা নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে মাল্টা বেশ উপকারী। ভিটামিন সি ‘র অভাবে যেসব রোগ হয় মাল্টা তা পূরণ করতে সাহায্য করে। এতে থাকা খনিজ লবণ, ম্যাগনেশিয়াম,আয়রণ, পটাশিয়াম, ফসফরাস, জিঙ্ক, হজমে সাহায্য করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং পাকস্থলীর কার্যক্ষমতা বাড়ায়। তাই মাল্টার মৌসুমে সামর্থ অনুযায়ী প্রত্যেকে মালটা খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
হুমায়ুন কবির,রাণীশংকৈল (ঠাকুরগাঁও)প্রতিনিধি