লামায় পাহাড়ি ঢলে সড়কের ব্যাপক ক্ষতি,দেওয়াল ধসে নিহত ১

Generic placeholder image
  Ashfak

বান্দরবানের লামা উপজেলায় গত বুধবার থেকে টানা ৭ দিনের বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সৃষ্ট বন্যার পানি গত মঙ্গলবার রাত থেকে নামতে শুরু করায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ততক্ষণে ঢলের পানিতে প্লাবিত ও পাহাড় ধসে পৌরসভা এলাকাসহ ৭টি ইউনিয়নে প্রাথমিকভাবে ২ হাজার ৭০০টি বসতঘর আংশিক এবং সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতির মধ্যে পৌর শহরের ৫০০টি দোকান. একটি খাদ্য গুদাম ও ৬০০টি বসতঘর রয়েছে। এছাড়া ৭টি ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৬শ বসতঘর। অপরদিকে প্রবল বর্ষণে মঙ্গলবার সকালে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী নিচ পাড়ায় ঘরের মাটির দেওয়াল ধসে পড়ে নিহত হন জরিনা বেগম নামের এক নারী। ঢলের পানিতে ক্ষতি হয় আমন বীজতলা, মৌসুমি ফসল, ফলদ-বনজ বাগান ও মৎস্য চাষের। এছাড়াও পাহাড় ধসে ভেঙ্গে উপজেলার প্রধান সড়ক সহ অভ্যন্তরীন রাস্তা ঘাট তছনছ হয়ে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা জানান, এ দূর্যোগে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা দুই দিন পৌরসভা ও বিভিন্ন ইউনিয়নের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে থাকার পর মঙ্গলবার রাত থেকে প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে ঢলের পানি নামতে শুরু করে। তবে বুধবার বিকেল পর্যন্ত পর্যন্ত পুরোপুরি পানি নেমে না যাওয়ায় অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নেয়া বন্যা কবলিতরা এখনো নিজ ঘরে ফিরতে পারেনি। আশ্রয়কালীণ সময় পানিবন্দি ও আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের পৌরসভার পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে পাহাড়ি ঢলের পানিতে রিংওয়েল ও টিউবওয়েলগুলো প্লাবিত হওয়ায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে বন্যা কবলিত এলাকায়। ঢলের পানিতে পৌরসভা এলাকায় সাড়ে ১ হাজার ১০০ বসতঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত ও পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ ঘর দোকান পাট পরিস্কারের কাজ শুরু করেছেন। জানতে চাইলে লামা সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন জানান, ঢলের পানিতে ৫০০ বসতঘর প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি পাহাড় ধসে ২০০ বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢলের পানিতে রুপসীপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে প্লাবিত ও পাহাড় ধসে ৩০০টির মত বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়  বলে জানান ইউপি চেয়ারম্যান ছাচিংপ্রু মার্মা। ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান নুরুল হোছাইন চৌধুরী বলেন, ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১০০টির মত বসতঘরের। এছাড়া পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতের টানে লামা-ফাঁসিয়াখালী সড়কের ইয়াংছা খালের উপর নির্মিত বিকল্প ব্রিজটি ধসে পড়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মঙ্গলবার সকালে মাটির ঘরের দেওয়াল ধসে নিহত হয় কুমারী নিচ পাড়ার বাসিন্দা আবুল হোসেনের স্ত্রী জরিনা বেগম (৩৬)। সরই ইউনিয়নে ঢলের পানির ¯্রােতের টানে সরই-লোহাগাড়া সড়কের উপর নবনির্মিত ব্রিজের দু পাশের মাটি সরে গিয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, ভেঙ্গে যায় ক্যয়াজুপাড়া-পুলং পাড়া সড়ক, লামা-সরই সড়কের টংগঝিরি ও আমতলী এলাকায় সড়ক ভেসে গেছে, অর্ধশতাধিক মৎস্য খামার প্লাবিত ও ভেঙ্গে যাওয়ার পাশাপাশি পাহাড় ধসে ১০টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়  বলে জানায় সরই ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইদ্রিস কোম্পানী। ফাইতং ইউনিয়নে পাহাড় ধসে ৪০টি ও গজালিয়া ইউনিয়নে ২০০ বসতঘর প্লাবিত ও পাহাড় ধসে ১০টি বসত ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানান ইউপি চেয়ারম্যান বাথোয়াইচিং মার্মা ও ওমর  ফারুক। অপরদিকে পৌরসভা ও প্রতিটি ইউনিয়নে বিভিন্ন স্থানে সড়ক ধসে পড়ে, পানি স্রোতের টানে ও সড়কের ওপর পাহাড় ধসে পড়ে অভ্যন্তরীন সড়কে যানবাহন চলাচলে দারুণ ব্যঘাত ঘটছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানরা। এছাড়া পাহাড় ধসে ও পানিতে প্লাবিত হয়ে উপজেলায় ৭০০ হেক্টরের বেশি জমির আমন বীজ তলা, মৌসুমি ফসল ও ফলদ বনজ বাগানের ক্ষতি হয়েছে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তা রতন চন্দ্র বর্মন।  
পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত আবুল হোসেন, জাকির হোসেন, সিদ্দিকুর রহমান ডন, কুতুব উদ্দিন সহ আরো অনেকে জানায়, ব্যবসায়ীরা প্রথমে মালামাল দোতলায় তুলে নেয়। কিন্তু সেখানেও দ্রুত পানি ঢুকে পড়ে। এতে করে কোন মালামাল রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই ৪-৫ বার বন্যা শিকার হতে হয় পৌর শহরের ব্যবসায়ী সহ হাজার হাজার মানুষকে। তবুও এ বন্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করছেনা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি কিংবা মন্ত্রীরা। ফলে চীনের দু:খ যেমন হোয়াংহু, এখন লামা শহরের মানুষের দু:খ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাতামুহুরী নদী। এ দু:খ দূর করতে প্রস্তাবিত মাতামুহুরী নদীর গতি পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই বলে জানান ভুক্তভোগীরা। তারা মাতামুহুরী নদীর গতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুরের হস্তক্ষপ কামনা করেন।  
লামা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আমান উল্লাহ ও সাধারণ সম্পদাক বিপুল নাথ বলেন, লামার ইতিহাসে এটায় সবচেযে বড় বন্যা। এ বন্যায় বাজারের ৫০০ ব্যবসায়ীর প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কোন ব্যবসায়ীই মালামাল রক্ষা করতে পারেনি। এত বড় ক্ষতির কারণে ব্যবসায়ীরা এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ব্যবসায়ীরা কিভাবে এ ক্ষতি কেটে উঠবে আমাাদের জানা নেই।  
এ বিষয়ে লামা পৌরসভা মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, টানা বর্ষণের শুরুতেই ঢলের পানিতে ও পাহাড় ধসের ঝুঁকিপূর্ণ পৌরবাসিদেরকে যথাসময়ে নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করে সতর্ক করা হয়। এরপরেও ঢলের পানিতে ও পাহাড় ধসে সহ¯্রাধিক দোকানপাট ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৌরসভার পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্রসহ বন্যা কবলিতদের মাঝে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি বিতরন করার পাশাপাশি পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে পৌরসভার গুরুত্বপূর্ন সড়ক সমূহ ও অলিগলিতে জমে থাকা পলি ও ময়লাআবর্জনা অপসারণ শুরু করা হয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল না থাকায় ও রাস্তা  ঘাট ভেঙ্গে চুরে তছনছ হওয়ার কারণে বুধবার পর্যন্ত পাহড়ি ঢলে ও পাহাড় ধসে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরুপন করা সম্ভব হয়নি। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দ্রুত নির্ণয়ের কাজ চলছে বলে জানান নির্বাহী অফিসার মো. মোস্তাফা জাবেদ কায়সার। ঢলের পানিতে ও পাহাড় ধসে ক্ষয়ক্ষতির সত্যতা নিশ্চিত করে লামা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মোস্তফা জামাল জানান, ৭ দিনের টানা বর্ষণের ফলে উপজেলায় পাহাড়ি ঢলের পানিতে ও পাহাড় ধসে অসংখ্য ঘরবাড়ি ও দোকান পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৌরসভাসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিরানব্বই ভাগ রাস্তাঘাট ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেছে। এছাড়া মৎস্য চাষ, সবজি ও ধানেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জাহিদ হাসান, লামা(বান্দরবান)প্রতিনিধি

মন্তব্য করুন হিসাবে:

মন্তব্য করুন (0)